মা র্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমবারের মতো ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডে যাচ্ছেন। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর সারা বিশ্বের নজর এখন এই সম্মেলনের দিকে।
অতীতে ট্রাম্প ইউরোপীয় মিত্রদের ‘ফ্রিলোডার’ বলে কটাক্ষ করেছেন, যা জোটের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এবার ইউরোপের দেশগুলো তাকে বোঝাতে চায় যে, তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট দায়িত্বশীল। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে এই সম্মেলনের পরিকল্পনা করেছেন ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে, যেখানে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয়ে জিডিপির ৫% বরাদ্দ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে স্পেন এই চুক্তি থেকে নিজেদের বিরত রাখার দাবি জানালেও রুটে তা অস্বীকার করেছেন। ইরানের বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির কারণে ট্রাম্প শেষ মুহূর্তে সম্মেলনে না আসার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। এতে সম্মেলনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
ইউরোপীয় নেতারা সম্মেলনে কূটনৈতিক সমাধান চেয়েছিলেন, বোমা বর্ষণ নয়, যা নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। ইউরোপ চায় যুক্তরাষ্ট্র যেন ইউরোপ থেকে সেনা প্রত্যাহার না করে, কারণ ১ লাখ মার্কিন সেনা ইউরোপে অবস্থান করছে, যার মধ্যে ২০ হাজার রয়েছেন পূর্ব ইউরোপে। ইউরোপ এখনও গোয়েন্দা তথ্য, নজরদারি, বিমান শক্তি এবং কমান্ড ব্যবস্থার জন্য মার্কিন সহায়তার ওপর নির্ভর করে। রাশিয়া ও চীনের চোখ এখন পশ্চিমা জোটের দুর্বলতা খুঁজে বের করার দিকে।
ট্রাম্পের অনিশ্চিত অবস্থান ইউরোপের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। জার্মানি ও পোল্যান্ড সেনাবাহিনী বাড়ানোর পরিকল্পনা করলেও, এখনই মার্কিন বিকল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র রেখেছে ইতালি, বেলজিয়াম, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডে। ন্যাটোতে মার্কিন নেতৃত্ব সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ইউরোপের কিছু দেশ আগে ফ্রান্সের পারমাণবিক ছাতার আওতায় আসতে চায়নি, যাতে মার্কিন অংশগ্রহণে সন্দেহ তৈরি না হয়। তবে বর্তমানে ইউরোপ নিজেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হচ্ছে, ট্রাম্পের সম্মতি অর্জন এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা মোকাবেলায়। রুটে চাচ্ছেন সম্মেলনে অর্থনৈতিক দিকটিকেই কেন্দ্রে রাখা হোক, যাতে ট্রাম্পের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানো যায়। ট্রাম্প চাচ্ছেন ইউরোপীয় মিত্ররা যেন জিডিপির ৫% প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে, তবে নিজে সে ব্যয়ে অংশ নিচ্ছেন না।
তিনি বলেছেন, “আমরা অনেক দিন ধরেই ন্যাটোকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি।” এই মন্তব্য ইউরোপীয় কূটনীতিকদের হতাশ করেছে। ইউরোপের দেশগুলো বলছে, এত বিপুল ব্যয় বহন করতে হলে জনগণের ওপর নতুন কর আরোপ, ঋণ গ্রহণ, অথবা কল্যাণ খাতে কাটছাঁট করতে হবে। অর্থাৎ “ট্যাংক না পেনশন” বিতর্ক ফের সামনে এসেছে। এসকেএল ইনভেস্টমেন্ট ফোরামের সাবেক সহকারী সেক্রেটারি ক্যামিল গ্র্যান্ড বলছেন, এই খরচ মানে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো নতুন ব্যয়। পোল্যান্ড নিজেকে নেতৃত্বে দেখতে চায়, কারণ তারা ইতিমধ্যে জিডিপির ৪.৭% প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বরাদ্দ দিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি।
তবে স্পেনের মতো দেশের জন্য এটি রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে। রাশিয়া যেভাবে যুদ্ধ অর্থনীতিতে প্রবেশ করেছে, তাতে আগামী ৫ বছরের মধ্যে তারা ন্যাটো দেশ আক্রমণ করতে সক্ষম হবে বলে আশঙ্কা করছেন মহাসচিব। প্রতিরক্ষা খরচ কেবল পরিমাণ নয়, গুণগত মানও গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপে একই ধরনের বহু অস্ত্র সিস্টেম এবং ১৭ প্রকার ট্যাংক বিদ্যমান, যা দক্ষতা হ্রাস করে। সম্মেলনে এইসব সমন্বয়ের বিষয়টি আলোচনার বাইরে থেকে যেতে পারে। ন্যাটো এখন ৫% ব্যয়কে ভাগ করে দেখাতে চায়: ৩.৫% সরাসরি প্রতিরক্ষা, বাকি ১.৫% প্রতিরক্ষা-সম্পর্কিত খাতে, যেমন নেদারল্যান্ডে সমুদ্রবন্দর উন্নয়ন বা ফ্রান্সে সাইবার নিরাপত্তা খাত।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘোষণায় দেখা গেছে, ন্যাটোর ইউরোপীয় কমান্ডে একজন মার্কিন জেনারেল নিযুক্ত করা হয়েছে, যা কিছুটা আশ্বাস জোগাচ্ছে। তবে ইউক্রেনের জন্য নতুন কোনো মার্কিন তহবিলের সম্ভাবনা কম। পূর্ব ইউরোপে অতিরিক্ত ২০ হাজার মার্কিন সেনা প্রত্যাহারই হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ।
এই সব অনিশ্চয়তার মাঝে, রুটে এবং ইউরোপের মিত্ররা চেষ্টা করছেন একটি একতাবদ্ধ বার্তা দিতে। ন্যাটোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ওপর। তাই এই সম্মেলন হতে পারে শীতল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত — যখন ইউরোপ নিরাপত্তায় আরও আত্মনির্ভর হওয়ার দিকে প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ নিল।
দৈনিক ইনফো বাংলা